নূরজাহান নীরা
শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আর এ মেরুদণ্ড সোজা রাখার দ্বায়িত্ব শিক্ষকদের।এ দ্বায়িত্ব পালনের জন্যই শিক্ষকরা সম্মানের উর্ধ্বে। আমি আমার শিক্ষকদের সম্মান করি,এখনও শিক্ষকদের সামনে নত মাথায় চলি,কথা বলি।মাদ্রাসায় শিক্ষা শুরু হলেও পরে স্কুলেই চলে আসি।ক্লাস সেভেনের ১ম সাময়িক পরীক্ষার পর ভর্তি হই স্কুলে।আমার ভর্তি রোল ছিলো ৯৩। ফাইনাল পরীক্ষা দিয়ে যখন এইটে উঠি তখন রোল হয় ১৩। তারপর নতুন ভর্তি হলেও স্যারদের কাছে ভালো ছাত্রী হয়ে উঠি। এইটে বৃত্তি দিতে চেয়েছিলাম,এর জন্য কোন প্রাইভেট পড়ার ব্যবস্থা ছিলো না,তবে হেড স্যার রুটিন ক্লাস শেষে আমাদের পড়াতেন।যারা বৃত্তি দিতে আগ্রহী ছিলাম তাদের।বিনিময়ে স্যার কোন টাকা নিতেন না, শুধু দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করতে হয়েছিলো।কারণ স্যারের বাসা ছিলো বেনাপোল।ধান্যখোলা থেকে বেনাপোলের দূরত্ব বেশ।কোন বিশেষ কারণে আর বৃত্তি পরীক্ষা দেওয়া হয় নি। নাইন টেন এ দুবছরেও কোন প্রাইভেট বা কোচিং পড়িনি।বিজ্ঞান বিভাগে পড়েছিলাম।আলাদা কোন বিজ্ঞান ভবন না থাকায় বিজ্ঞান বিষয় গুলোর ক্লাস হতো স্কুল মাঠের গাছ তলায় অথবা কোন ভবনের বারান্দায়।গাছতলায়-ই বেশি ক্লাস করেছি।স্যারেরা এমন ভাবে পড়াতেন যেনো ক্লাসে ই পড়া মুখস্থ হয়ে যেতো।মূল বই কিনতেই হিমশিম খেতে হতো।নোট বই কেনা হতই না।বাংলা আর ইংলিশ এ দুটি নোট বই দিয়ে চলতো।আর বাকি গুলো মূল বই পড়ে উত্তর দিতাম।তবে আমাদের মনোযোগ ছিলো। ধান্যখোলা মাধ্যমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর আমিই প্রথম মেয়ে যে সাইন্স নিয়ে পড়েছি,একটু প্রতিবন্ধকতা নিজের কাছে মনে হলেও স্যারেরা উদার সহজ ছিলেন যার কারণে কোন সমস্যাই হয় নি।তবে সাথে আর কোন মেয়ে না থাকায় একদিনও ক্লাস মিস করতাম না,মিস পড়া উঠাতে পারবো না বলে।বিজ্ঞানের বিষয়গুলোতে লেটার মার্ক থাকতো।খুব মনে পড়ে প্রথম এসএসসিতে যখন ফেল করেছি, আমার সাথে স্যারেরাও কেঁদেছেন।ছোট ভাইটা অনেক দিন কেঁদেছেন।রসায়নে অবজেক্টিভে এক নাম্বারের জন্য ফেল? স্যারদের মানতে কষ্ট হচ্ছিলো। আমি স্যারদের বলেছিলাম,আমি জানা ত্রিশটি টিক দিয়েছি, কেন ফেল করলাম? স্যারদের সাপোর্টে সব কষ্ট ভুলে গেছিলাম।মনের কাছে সে ঋণ আজও।কৃতজ্ঞতায় নূয়ে আসে মন স্যারদের প্রতি।এরপর যখন কলেজে ভর্তি হলাম,সেখানেও সাইন্সের কোন মেয়ে নেই,আমি একা।সেখানেও বাংলা ইংলিশ ছাড়া কোন নোট বই নেই।এইচএসসিতে জীববিজ্ঞান ঐচ্ছিক করেছিলাম।ছোট ভাইয়ের খুব ইচ্ছে ছিলো এমবিবিএস পড়াবে।২০০০সালের বন্যায় সব স্বপ্ন অপূরণ রেখে পাড়ি জমালেন পরপারে।তবুও ভাইয়ের স্বপ্ন মনে রেখেই সাইন্স নিলাম।পরে যখন জানলাম এমবিবিএস পড়া আমাদের সাধ্যের বাইরে তখন ইচ্ছেটা পাল্টে নিলাম।অংকটা নিলাম।বেনাপোল কলেজে রফিক স্যার অংক ক্লাস নিতেন।প্রদীপ স্যার,মতিয়ার রহমান স্যার,শাহিন স্যার বিজ্ঞানের ক্লাস নিতেন।প্রতিটি বিষয় এমন ভাবে পড়াতেন যেনো ক্লাসেই পড়া মুখস্থ হয়ে যেতো।সাত নং ঘিবা থেকে বেনাপোল কলেজ পায়ে হেঁটে যাওয়া আসা এর পর পড়া করা, যদি ক্লাসে পড়া মুখস্থ না হতো তাহলে পড়া করা সম্ভব হতো না।খুব মনে পড়ে ক্লাস পরীক্ষায় একবার অংকে ৯৯ পেয়েছিলাম।স্যার খুব খুশি হয়েছিলেন।যখন সেকেন্ড ইয়ারে উঠলাম,একদিন প্রদীপ স্যার বললেন,নূরজাহান ফাস্ট ইয়ারের ক্লাসটা তুমি করাও।আমিতো অবাক! স্যার অভয় দিয়ে বললেন,ভয় পেওনা।এ কলেজেই তোমাকে দেখতে চাই এভাবে।প্রদীপ স্যার রসায়ন পড়াতেন।খুব ভালো বুঝতাম রসায়ন।টেস্টে ভালো রেজাল্ট করেছিলাম।বাংলায় পেয়েছিলাম মাত্র ৫৭।নাবিউননাহার ম্যাডাম বাংলা নিতেন।ক্লাসে ম্যাডাম অনেকটা রাগ করেই বললেন, নূরজাহান এটা কি নাম্বার পেয়েছো? এটা তোমার থেকে আশা করিনি? যেখানে অন্য সাবজেক্ট এত ভালো করেছো।যদিও ওটাই ছিল হাইস্ট নাম্বার তবুও ম্যাডাম সন্তুষ্ট হয়নি।আমি আর একটা ছেলে সর্বোচ্চ বাংলায় সাতান্নই পেয়েছিলাম।স্যারদের সেই ভালোবাসা,সহযোগীতা কোন দিন ভুলবো না, ভুলা যায় না।রেজিস্টেশন করার টাকা দিতে পারছিলাম না,স্যারেরা সহযোগীতা করেছিলেন।ফাইনাল পরীক্ষা আর দেওয়া হয় নি।প্রবেশপত্র হাতে নিয়ে কাঁদতে কাঁদতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম।স্যারেরা কতটুকু কষ্ট পেয়েছিলেন সেটা আর জানা হয় নি।মেয়েকে বললাম, সাইন্স তোমাকে নিতে হবে।আমার স্বপ্নেরা আজ বেঁচে আছে,সতেজ আছে শুধু সময়টা আমার হাতে নেই ওটা তোমাদের হাতে,সময়কে কাজে লাগাও।তো মুশকিল, সেই জাতির মেরুদণ্ডের ধারকরা কি আগের মত আছে।এখন ক্লাস ফাঁকি হয়।কোচিং ব্যবসা।কোচিংয়ে ভর্তি হতে হয় তিন থেকে পাঁচ হাজার টাকায়।মাসিক ফি,পরীক্ষা ফি।আরেক স্কুল খরচ।এর মাঝেও নেই সেই আন্তরিকতা,ভালোবাসা,দায়িত্বের ভার।শুধুই ব্যবসা।বিজ্ঞানের টিচার মানেই অসম্ভব কিছু,পেতেই কষ্ট, আগেই টাকার হিসেব।সপ্তাহে তিনদিন পড়াবে,একঘণ্টার বেশি না,পাঁচের নিচে পোষে না।তবুও শিক্ষকদের প্রতি শ্রদ্ধা।